এস,এম, নজরুল ইসলামের জীবন ঘনিষ্ট গল্প-কথা (০১)
এই সমাজে মানুষের আত্নহত্যা প্রতিরোধে বেসরকারী পর্যায়ে গড়ে উঠেছে “সুইসাইড প্রোটেক্টিং স্কোয়াড বাংলাদেশ” নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। আত্নহত্যা প্রতিরোধ করে মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে এই সুইসাইড প্রোটেক্টিং স্কোয়াড বাংলাদেশ। আজ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি ২৭০ জন হতাশাগ্রস্থ মানুষকে আত্নহত্যার চিন্তা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে যে কারনে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে আত্নহত্যা ১৩তম।
গত ১১-১০-২০২২খ্রি: তারিখে দৈনিক আজকের প্রত্রিকায় প্রকাশিত আত্নহত্যা প্রতিরোধ সংক্রান্ত আর্টিকেলটি পড়ার সময় আমার মনে পড়ে গেল, বিগত ২০১০ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমার জীবনে স্বাক্ষী হয়ে থাকা এমনি একটি ঘটনার স্মৃতি।এক বিকেলে ঢাকার খিলগাও রেলগেইটে ট্রেনের নীচে আত্নহত্যা করতে যাওয়া একজন গৃহবধূকে বাঁচানোর অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনা।এতোদিন এই ঘটনাটি আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ আবার মনে পড়ে গেল। তাই ফেসবুক/অন-লাইন বন্ধুদের জন্য ঘটনাটি লিখছি-
স্মৃতিতে যতটুকু মনে পড়ে, দিনটি ছিল বৃহসপতিবার, সেপ্টেম্বর, ২০১০ সন। সে সময় আমি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডা: কর্পোরেশনে চাকুরী করি। আমার কর্মস্থল ঢাকার দিলকুশাস্থ বিসিআইসি'র প্রধান কার্যালয়, বিসিআইসি ভবন থেকে ১ঘন্টা আগে শর্ট লীভ নিয়ে আগে বের হয়ে ৪.০০ টার দিকে আমি ও আমার বন্ধু শহীদুল ইসলাম (বর্তমানে মালয়েশিয়া প্রবাসি) ঢাকার ফকিরাপুল থেকে রিক্সাযোগে খিলগাও রেল গেটে আসি। প্রচন্ড রিক্সা জ্যাম থাকায় একটু পশ্চিমে থাকতেই আমারা শাহজাহানপুর অংশে নামলাম। যদিও আমাদের গন্তব্য ছিল খিলগাও তালতলা মার্কেট। ট্রেন যাচ্ছে বলে রেলগেইটের লেভেল ক্রসিংয়ের বার ফেলে রোড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।সময় বাঁচানোর জন্য ভাবলাম, পায়ে হেটে ওপাশে গিয়ে আরেকটি রিক্সা ভাড়া নিয়ে গন্তব্যে যাব। কিন্তু পয়ে হেটে ক্রসিং বারের কাছে এলে লাইন ম্যান বললো, সাবধান ট্রেন এসে পরেছে তা্ই রেল লাইন পার হবেন না । ডানে তাকিয়ে দেখলাম কমলাপুর ষ্টেশন থেকে একটি ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে দ্রুত আসছে। অন্যান্যদের সাথে আমি ও আমার বন্ধু লেভেল ক্রসিংবার ঘেঁষে দাড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ একজনের মৃদু ধাক্কায় পিছনে তাকালাম, দেখলাম কালো পাকিস্তানী বোরকা পরা একজন ম্লিম গড়নের মহিলা আমার গা ঘেষে নামাজের কাতারে দাড়ানোর মতো করে জোড় করে জায়গা নিয়ে দাড়ালো। কালো ওড়নাতে অর্ধেক মুখ ঢাকা ফর্সা মেয়েটি কাপছিল, আমি তার নি:শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সে বারবার উকি মেরে সামনে ঝুকে ট্রেনের আগমন দেখছিল। আমি তাকে সাবধান করলাম আর সরে এসে পেছনে দাড়াতে বললাম। এরই মধ্যে ট্রেনটি চলে এসেছে কাছাকাছি। ঐ মেয়েটি আঁচমকা দুইবার সামনে ঝুকলো । চাপা জায়গায় বারবারই আমার শরীরের সাথে ঝাকি লাগছিল। আমি মেয়েটির অস্বাভাবিক আঁচরন ফলো করছিলাম। সে দ্রুতই ৩য় বার মাথা নীচু করে শরীর বাঁকিয়ে সামনে দিকে শরীরকে লাফ দেয়ার ভংগিমা করতেই আমার অবচেতন বুঝে গেল মেয়েটি আত্নহত্যার জন্য নিজেকে সমর্পন করতে যাচ্ছে। হঠাৎ করে আমার অবচেতন মনের নির্দেশে আমার ডান হাতটি স্বজোড়ে মেয়েটিকে তার ঘাড়ের কাপড়সহ চুলের মুঠি ধরে হেচকা টানে পিছন দিকে ফেলে দিলাম। আমি আজও ভাবতে পারি না আমি কিভাবে প্রবল শক্তি দিয়ে ঐ কাজটি করেছিলাম ? মূহুর্তেই এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধূলোর বাতাস উড়িয়ে সাই করে চলে গেল। মেয়েটির বোরকার আচলটি ট্রেনের সাথে লেগে ফিরে এলো। পিছনে ধাক্কা লেগে আমরা দুজনেই মাটিতে বসে পড়লাম। তবে পাশে ও পিছনে আরও মানুষ দাড়ানো ছিল বলে তাদের সাথে বাধা পেয়ে আমরা পিছনে মাটিতে পরে যাইনি। সবাই ভেবেছিল, আমরা দু'জনে হয়তো ট্রেনের সাথে ধাক্কা খেয়েছি। আল্লাহ সত্যি মেহেরবান কারন এমনও হতে পারতো যে, সেদিন আমার মুষ্ঠিবদ্ধ শক্ত হাতের বাঁধনের চেয়ে যদি আত্নহত্যায় নিবেদিতা মেয়েটির ঝুকে পড়ার শক্তি বেশী হতো তবে হয়তো আমরা দু’জনই সেদিন একসাথে ট্রেনের নীচে কাটা পড়তাম এবং এক সাথেই আমরা মারা যেতাম।
আমরা বেঁচে গেলাম, অত:পর আমি প্রথমে মেয়েটিকে দু’হাতে ধরে উঠে দাড়াতে সাহায্য করালাম, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করলাম, মেয়েটি বয়স হবে হয়তো ২৫/২৬ বছর। আমি তাকে ঝাকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে ? কেন মরতে চেয়েছিলেন? তখন আমাদের চারিদিকে উপস্থিত মানুষের ভীষন জটলা বেধে গিয়েছে। উপস্থিত সবাই বুঝে গেল যে, মেয়েটি আত্নহত্যা করতে চেয়েছিল। ট্রেন চলে গেছে, লেভেল ক্রসিংয়ের বার উঠে গেছে। যানবাহন চলতে শুরু করেছে। সবাই বলাবলি করতে লাগলো ভাই মেয়েটি কি আপনার কেউ হয়? আমি বললাম, না তাকে আমি চিনি না, আমি পথচারী। আমাকে দিয়ে আল্লাহ তাকে বাচিয়েছে। সবাই বললো, ভাই আপনি মেয়েটিকে বাঁচিয়েছেন, আপনিই তাকে বাসায় পৌছে দিন। তা না হলে সে আবার ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিবে। আমি মেয়েটির খোলা মুখের দিকে তাকালাম, সে বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে এবং উচ্চস্বরে অজোরে কাঁদছে আর বলছে, আমি মরতে পারলাম না, কেন বাঁচালেন আমাকে? আমি আমার ১(এক) বছরের ছোট মেয়েটিকে খালি বাসায় খাটের উপর বসিয়ে রেখে এসেছি। উপস্থিত লোকজন বলাবলি করতে লাগলো- মেয়েটি বিবাহিতা, হয়তো স্বামীর অত্যাচারে মরতে এসছিলো, কেউ বললো কষ্টের কারনে। কিন্তু আমি মেয়েটিকে কোন কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। মেয়েটিকে আমরা রেল ক্রসিং থেকে রেল লাইনের পূর্ব পাশে এনে শান্ত করলাম। তারপর শান্ত গলায় আমি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলাম, আপনার বাসা কোথায়? সে বললো, শাহজাহানপুর আমতলা থেকে ডান দিকের রাস্তা বরাবর একটু সামনে ডানের গলিতে। লোকজন আবার আমাকে বললো, ভাই আপনি বাঁচিয়েছেন তাই মহিলার সাথে আপনি যান আর তাকে তার স্বামীর জিম্মায় দিয়ে আসেন। আমার বন্ধু শহীদুল কিভাবে ঘটনাটি ঘটলো সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। হয়তো সে বিষয়টিতে কোন গূরুত্বই দিচ্ছিল না। আর সে আমাকে তাড়া দিচ্ছিল চলো তাড়াতাড়ি ঠিক সময়ে তালতলা মার্কেটে যেতে হবে। আমি বন্ধুর মুখের দিকে একবার তাকালাম। তারপর আমি মেয়েটিকে একটি রিক্সা ঠিক করে দিলাম। মেয়েটির শরীর কাঁপছিল তাই মেয়েটিকে রিক্সাতে বসতে হেল্প করলাম, রিক্সার হুট উঠিয়ে দিলাম এবং রিক্সাচালককে বললাম, ভাই এই নিন ভাড়া ২০/- টাকা তাকে যতনে শাহজাহানপুর আমতলার কাছে তার বাড়ীতে পৌছে দিবেন। আমার বন্ধু আমার হাত ধরে টানছিল তালতলাতে যাওয়ার রিক্সাতে উঠার জন্য আর আমি তাকিয়ে ছিলাম রেলগেইট পেরিয়ে মেয়েটি চলে যাওয়ার রিক্সাটির দিকে।
আজ এতোদিন পরে রেলগেইটের লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের নীচে পড়ে আত্নহত্যায় চেষ্টা করা মেয়েটির কথা খুব মনে পড়ছে। জানি না, ঐ মেয়েটি কি দ্বিতীয় বার আত্নহত্যা করতে চেয়েছিল কিনা ? যদি গৃহবধূটি আজও বেঁচে থাকে তবে হয়তো তার ছোট্ট মেয়েটির বয়স হবে ১৪ (চৌদ্দ বছর)।
আত্নহত্যা করতে যাওয়া মেয়েটিকে বাঁচাতে সেদিনের আমার অবচেতন মনের ঐ ছোট্ট প্রচেষ্টার কথা ভাবতে খুব ভাল লাগে। আমি মেয়েটির নাম জানি না। আমার কাছে মেয়েটির কোন ঠিকানা জানা নেই। মেয়েটিকে আমি ভাল করে জানতে পারিনি তাই আমার স্মৃতিতে মেয়েটি দূর থেকে দূরে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। জানি না, সে ইন্টারনেট বা টাচ মোবাইল ফোন অপারেট করতে জানে কিনা ? আজকাল ফেসবুকে তো অনেক হারানো মানুুষকে খুজে পাওয়া যায়। মেয়েটির অশ্রুসজল আবছা চেহারাটি আমার ঠিক মনে নেই। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে খিলগাও রেলগেইটে ট্রেনের নীচে আত্নহত্যা করতে যাওয়া ভালবাসা বঞ্চিত সেই য়েটি আজও বেঁচে আছে কিনা ? নাকি সে আবার আত্নহত্যা করেছে ?
লেখক: এস, এম, নজরুল ইসলাম।
ই-মেইল: recentbd@gmail.com
মেবা্বাইল: +৮৮০১৬৭৩২৬৮৪৪৬
https://fb.watch/gTuluvMo_n/
লেখাটি কোন গল্প নয়, আমার জীবনের একটি সত্য ঘটনা।
ReplyDelete